Tuesday, June 30, 2020

ছোটবেলায় আমি তিলের খাজা বিক্রি করতাম: এরদোগান


দুনিয়ার অনেক দেশের রাষ্ট্রনেতারা বই লিখেছেন। সেসব বই বহুলপঠিত, আলোচিত এমনকি সমালোচিতও হয়েছে। তুরস্কের বর্তমান নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান বই লিখেননি, তবে এক নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার বই ভাবনা। 

আপনার ছোটবেলার প্রিয় উপন্যাস বা কবিতাটির কথা শুনতে চাই। বলুন, কবে আপনি ওটা প্রথম পড়েছিলেন এবং কিভাবে তা আপনাকে প্রভাবিত করে এরদোগান : আমি নিশ্চিত, প্রতিটি শিশুই সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয় ঘুমপাড়ানি গান ও রূপকথার মাধ্যমে। আমার মা (আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন) আমাদের বড় করে তুলেছেন অ্যানাতোলিয়া ও কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে শুনিয়ে। আমার মরহুম পিতার কাছে শুনেছি অ্যানাতোলিয়ার অসংখ্য সুন্দর গল্প ও রূপকথা। মনে আছে, ছোটবেলায় আমি তিলের খাজা বিক্রি করতাম। বিক্রিশেষে যা আয় হতো তা নিয়ে ছুটে যেতাম বাইয়ের দোকানে।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমার প্রজন্মে বেড়ে ওঠার সময়টি ছিল অস্থির। নানা জটিল বিতর্ক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় পরিপূর্ণ। ওই সময়টায় নানা রকম প্রতীক, স্লোগান ও বিক্ষোভের প্রবল প্রতাপে ভাবধারা (আইডিয়া) হারিয়ে যেতে বসেছিল।

কবর রচিত হয়েছিল বুদ্ধিমত্তার। ভিন্নমত সহ্য করার প্রবণতা তরুণদের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বই, সাময়িকী, সংবাদপত্র, কবিতা, উপন্যাস, গল্প এবং লেখকেরাও মূল্যায়িত হতেন তার রচনাটি কী উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে এবং এর গূঢ়ার্থ দিয়ে। তরুণেরা বই পড়ত, তবে কিছু জানার জন্য নয়, বরং নিজের ভাবধারার পক্ষে যুক্তি খোঁজার জন্য।

ওই অন্ধকার যুগে তরুণদের দৃশ্যপটের বাইরেই রাখা হতো। এমন দিনে আমি এবং আমরা বন্ধুরা নিজেদেরকে ওই গুমোট পরিবেশের বাইরে রাখতে সচেষ্ট হলাম। সমবয়সী অন্যদের মতো আমরা নিজেদের চোখ-কান বন্ধ রাখতে চাইলাম না, ক্ষুদ্র আদর্শিক বৃত্তে বন্দী থাকতে চাইলাম না এবং চাইলাম না এমন লোকদের মতো হতে, যারা নতুন যেকোনো ধারণাকেই হুমকি মনে করে।

আমরা জানতাম, দৃঢ় ভিত্তি ও স্থির নীতি ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হতে পারে না। আমাদের খুব জানা ছিল, ব্যাপক পড়াশোনা থাকলেই কেবল ভাববিনিময় ও বিতর্ক ফলপ্রসূ হতে পারে। তাই আমরা পড়াশোনার কষ্টকর পথটি বেছে বিলাম; ব্যাপক পড়াশোনা। আমাদের সর্বোচ্চ সাধ্যমতো আমরা সেসব লেখকের বই পড়তে থাকলাম, তুর্কি ও বিশ্বসাহিত্যকে যারা পথনির্দেশ দিয়েছেন।

এখানে আমি আরো একটা কথা জানিয়ে রাখতে চাই, তা হলো : আমাদের সময়টি ছিল এমন একটি সময়, যখন কোনো বই হাতে পাওয়াটা ছিল খুবই কঠিন। এখনকার মতো তখন এত বই, এত পাঠাগার ছিল না। এখন যেমন অনেক পরিবার বই কেনার জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ (বাজেট) রাখে, তখন এটা ছিল না। এখন যেমন কাউকে বাসে, পার্কে বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসে স্বাধীনভাবে বই পড়তে দেখা যায়, এমনটা তখন ভাবাই যেত না।

এমন অবস্থায়ও যখন আমরা কোনো বই হাতে পেতাম, সে বই এহাত-ওহাত ঘুরে কয়েক ডজন তরুণের পড়া হয়ে যেত। তখন ইন্টারনেট ছিল না, ফটোকপি মেশিনও নয়, তা সত্ত্বেও যেকোনো মহৎ সাহিত্যকর্ম কিংবা সুন্দর একটি কবিতা হাত থেকে হাতে একেবারে অ্যানাতোলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত।

এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের কাছে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কারণ তাদের হাতের নাগালে স্কুল, টেবিল ভরতি বই। কিন্তু আমাদের তো এসব ছিল না। আমরা এমন একটি প্রজন্ম, যাদের কাছে বই ছিল দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। কাজেই আমাদের জন্য এটাই স্বাভাবিক যে, আমাদের সন্তানদের হাতে যত সহজে সম্ভব বই তুলে দেয়ার জন্য আমরা সব রকম চেষ্টা করে যাবো।

ছোটবেলায় আমি যেসব গল্প ও কবিতা পড়েছি, তার থেকে একটিকে ‘প্রিয়’ হিসেবে বাছাই করতে বললে আমি কিন্তু পারব না। তারপরও বরেণ্য চিন্তাবিদ নেসিপ ফাজিল কিসাকুরেক এবং তার ‘সাকারিয়া’ কবিতাকে আমি শীর্ষে রাখব। এই মানুষটি এবং তার রচনা আমাদেরকে ইতিহাস ও বর্তমান সম্বন্ধে সচেতনতার বোধ দিয়েছে।

যদি আপনাকে বলা হয় তুরস্কের স্কুল পাঠ্যক্রমে নতুন একটি বই যোগ করতে, কোন বইটি বেছে নেবেন এবং কোন বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য?
এরদোগান: কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই আমি মেহমেত আকিফ এরোজির ‘সাফাহতে’ বইটির কথা বলব এবং চাইব, সব বয়সের মানুষ বইটি পড়–ক এবং বইটির সাথে পরিচিত হোক।

কারণ এটি একটি মহৎ সাহিত্য বা কাব্যই শুধু নয়, বরং এটি এমন একটি রচনা, যা আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের ওপর আলো ফেলেছে। এটি একটি দর্শনের বই, যে দর্শনের ভিত্তিতে একটি জাতি ও একটি সভ্যতা নির্মিত হয়েছে। এটি একটি ভাবধারার বই, যে ভাবধারা আমাদের আমাদের অতীত চেতনার সাথে ভবিষ্যৎকে মিলিয়ে দিয়েছে।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত যেমন এ জাতির পরিচয় জ্ঞাপকরূপে কাজ করে এবং যে ভিত্তির ওপর তা নির্মিত, ‘সাফাহাত’ বইটিও তেমন। এতে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের চেতনাই অনুরণিত হয়। যারা বইটি প্রথম পড়বেন, তাদের কাছে এর শব্দ ও স্তবকগুলো বুঝতে পারা কঠিন হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তরুণ বয়সে এরকম একটি সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচিত হলে,

এর পৃষ্ঠায় নিমজ্জিত হলে তা আমাদের তরুণদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। যে সমাজের শব্দভাণ্ডার যত ব্যাপক, সে সমাজের সৃজনশীলতাও তত বেশি।
সবচেয়ে বড় কথা, আমি বিশ্বাস করি, ‘সাফাহাত’ বইয়ের শব্দ ও স্তবকগুলো ইতিহাসের সাথে আমাদের বন্ধনকে দৃঢ় করবে এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমাদের কর্মপ্রচেষ্টায় আরো ত্যাগের মনোভাব জাগ্রত করবে।

আমাদের দেশে (কিংবা বিশ্বে) পরিবর্তন এনেছে, এমন কোনো বইয়ের নাম বলতে বললে আপনি কোনো বই বা লেখকের নাম বলবেন এবং কেন?
এরদোগান: আমার মনে হয় আপনি নিজেও বোঝেন যে, একটি বা দু’টি নাম বলে এলে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া প্রায় অসম্ভব। নিঃসন্দেহে পবিত্র কুরআন থেকে শুরু করে সব ধর্মগ্রন্থের চিরায়ত গুরুত্ব রয়েছে। এর বাইরে প্রত্যেক জাতির নিজস্ব অতিগুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সাহিত্যকর্ম রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা রুমী ও ইউনূস এমরের কথা বলব। তারা আমাদের এখানে, অ্যানাতোলিয়ায় বসে লিখেছেন। কিন্তু তাদের সৃষ্টি সব সীমান্ত অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ভেঙেছে সময়ের বেড়া। তারা আপন লোকালয়ে আবদ্ধ থাকেননি, বরং আলিঙ্গন করেছেন সমগ্র বিশ্বকে। ভাবতে অবাক লাগে, তাদের রচনা, তাদের কবিতা রচিত হয়েছে কয়েক শ’ বছর আগে। অথচ তা এখনো মানবতার পথপ্রদর্শক।

আমাদের সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ইতিহাস নিয়ে আমার সত্যিই গর্ব হয়। অবশ্য গর্বভরে উল্লেখ করার মতো আরো অনেক মহৎ সাহিত্যিক আমাদের দেশে আছেন। ইউসুফ হাস হাচিপ, আহমেত ইয়েসেবি, ফুজুলি, নেদিম, হাবি বেকতাস, কেমাল তাহির, ইয়াহিয়া কেমার, কেমিল মেরিক, ও গুজ আতাই, নুরেত্তিন তপকু, ওরহান পামুক এবং এ রকম আরো অনেকে মহৎ সাহিত্য রচনা করেছেন।

প্রতিটি লেখক, তাদের সাহিত্যকর্ম, এমনকি প্রতিটি স্তবক বা বাক্য, তা ছোট হোক বা বড়, মানুষকে প্রভাবিত করে। বলা হয়ে থাকে, ‘মুখের কথা উড়ে যায়, লেখা কথা থেকে যায়। লিখিত সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে পাঠকের ব্যক্তিগত জীবনের একটি দিকের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায়। এবং তা-ই এনে দেয় পরিবর্তন।

(তুর্কি সংবাদপত্র থেকে তরজমা)

No comments:

Post a Comment

ছয় যমজ সন্তান নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন জার্মান নারী

  ছয় যমজ সন্তান নিয়ে এক দশক আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন জার্মানির রুকসানা তামিজ। মুসলিম হবার পর হিজাব পরা শুরু করেন এবং পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন অনুশ...