Thursday, July 2, 2020

ইস্তাম্বুলের প্রাচীন গির্জা হাগিয়া সোফিয়া জাদুঘর থাকবে না মসজিদ হবে: তা ঠিক হবে আদালতে





তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের হাগিয়া সোফিয়া-কে মসজিদে পরিণত করা হবে কিনা–এ ব্যাপারে আজ সে দেশের এক আদালতের যে রায় দেবার কথা ছিল তা ১৫ দিনের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

দেড় হাজার বছরের পুরোনো ইস্তাম্বুলের হাগিয়া সোফিয়া এক সময় ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে। তারপর এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।

প্রেসিডেন্ট এরদোগানের তুরস্ক আবার এটাকে মসজিদে পরিণত করতে চায় এবং আদালত পক্ষে রায় দিলে তা হতে পারে।

তবে মাত্র ১৭ মিনিটের শুনানীর পর তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সংস্থা–দি কাউন্সিল অব স্টেট–বলেছে তারা ১৫ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি রুলিং দেবেন।

মসজিদ না জাদুঘর?

হাগিয়া সোফিয়া নির্মিত হয়েছিল ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তখনকার বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের নির্দেশে। প্রায় ১০০০ বছর ধরে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা।

পরে ১৪৫৩ সালে যখন ইস্তাম্বুল অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। তখন এটিকে পরিণত করা হয় মসজিদে।

১৯৩০ এর দশকে এটিকে পরিণত করা হয় এক জাদুঘরে। এটি এখন ইউনেস্কো-ঘোষিত একটি বিশ্ব-ঐতিহ্য স্থান।

তুরস্কের ইসলামপস্থীরা বহুকাল ধরেই চাইছিলেন এটিকে আবার মসজিদে পরিণত করতে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলীয় এমপিরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন।

তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের দিক থেকে হাগিয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করার সমালোচনা করা হয়।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানও বেশ কিছুকাল আগে হাগিয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করার কথা বলেন। গত বছর মি. এরদোগান এক নির্বাচনী সভায় এ পরিবর্তন আনার আহবান জানান।

ছবির কপিরাই

ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চের প্রধান এর বিরোধিতা করেছেন। গ্রিস–যে দেশে লক্ষ লক্ষ অর্থডক্স খ্রীষ্টানের বাস–তারাও এর বিরোধিতা করেছে।

গ্রিসের সংস্কৃতি মন্ত্রী লিনা মেনডোনি অভিযোগ করেছেন, তুরস্ক উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তুলতে চাইছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, হাগিয়া সোফিয়ার মত একটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানে ওই প্রতিষ্ঠানের আন্ত:-সরকার কমিটির অনুমোদন ছাড়া কোন পরিবর্তন করা যাবে না।

ইউনেস্কোর উপপরিচালক আরনেস্তো রামিরেজ একটি গ্রিক সংবাদপত্রে দেয়া সাক্ষাতকারে এর সাথে একমত প্রকাশ করে বলেছেন, এরকম পরিবর্তন আনতে হলে ব্যাপক ভিত্তিক অনুমোদন প্রয়োজন।

জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটি তুরস্কের কাছে এ প্রস্তাব সম্পর্কে একটি চিঠি দিয়েছে। কিন্তু মি. রামিরেজ জানান, তারা কোন উত্তর পাননি।

হাগিয়া সোফিয়ার বিচিত্র ইতিহাস:

বসপরাস প্রণালীর পশ্চিম পাড়ে ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় গম্বুজ শোভিত এ বিশাল ঐতিহাসিক ভবনটি খুব সহজেই দর্শকদের নজর কাড়ে।

সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে এ হাগিয়া সোফিয়া নির্মাণ শুরু হয়েছিল ৫৩২ খ্রীষ্টাব্দে। ইস্তাম্বুল শহরের নাম তখন ছিল কনস্টান্টিনোপল। যা ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী–যাকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যও বলা হয়।

ছবির কপিরাইI

এ সুবিশাল ক্যাথিড্রাল তৈরির সময় তখনকার প্রকৌশলীরা ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন।

হাগিয়া সোফিয়া নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চের প্রধানের অবস্থান। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই।

প্রায় ৯০০ বছর ধরে হাগিয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। অবশ্য মাঝখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একটি সংক্ষিপ্ত কালপর্ব ছাড়া, যখন চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিকরা এক অভিযান চালিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তারা হাগিয়া সোফিয়াকে একটি ক্যাথলিক ক্যাথিড্রালে পরিণত করেছিল।

কিন্তু ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় কনস্টান্টিনোপল। এর নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল। চিরকালের মত অবসান হয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের।

ছবির কপিরাইImage

হাগিয়া সোফিয়ায় ঢুকে বিজয়ী সুলতাম দ্বিতীয় মেহমেদ নির্দেশ দেন এটাকে সংস্কার করে একটি মসজিদে পরিণত করতে। তিনি এ ভবনে প্রথম শুক্রবারের সালাত আদায় করেন।

অটোমান স্থপতিরা হাগিয়া সোফিয়ার ভেতরের অর্থডক্স খ্রীষ্টান ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতীক-চিহ্নগুলো সরিয়ে ফেলেন বা পলেস্তারা দিয়ে ঢেকে দেন। ভবনের বাইরের অংশে যোগ করা হয় উঁচু মিনার।

ইস্তাম্বুলে ১৬১৬ সালে ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত হাগিয়া সোফিয়াই ছিল শহরের প্রধান মসজিদ। নীল মসজিদ সহ এ শহরের এবং দুনিয়ার অন্য বহু মসজিদের নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে এর স্থাপত্য।

প্রথম ওয়ার্ল্ড ওয়ার ১৯১৮ সালে শেষ হলে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। বিজয়ী মিত্রশক্তি গুলো তাদের ভূখন্ডকে নানা ভাগে ভাগ করে ফেলে। তবে ওই সাম্রাজ্যের অবশেষ থেকেই জাতীয়তাবাদী তুর্কী শক্তির উত্থান হয়। তারা প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক তুরস্ক।

ছবির কপিরাইটImage capti

তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল পাশা (কামাল আতাতুর্ক) আদেশ দেন, হাগিয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে পরিণত করতে।

হাগিয়া সোফিয়াকে ১৯৩৫ সালে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর এটি তুরস্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্থলে পরিণত হয়েছে।

এ হাগিয়া সোফিয়া এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

তুরস্কের ভেতরে এবং বাইরে বহুগোষ্ঠীর জন্য হাগিয়া সোফিয়ার ১৫০০ বছরের ইতিহাস ব্যাপক ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

উনিশ'শ চৌতিরিশ সালে করা এক আইনে এই ভবনটিতে ধর্মীয় প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ইসলামপন্থী এবং ধার্মিক মুসলিমরা দাবি করেন যে, হাগিয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করা হোক। তারা ওই আইনের বিরুদ্ধে ভবনটির বাইরে বিক্ষোভও করেছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বক্তব্যে এ দাবির প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। গত বছর স্থানীয় নির্বাচনের আগে এক প্রচার সভায় দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, হাগিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ছিল এক “বিরাট ভুল।“

এর পর তিনি তার সহযোগীদের নির্দেশ দেন কিভাবে ভবনটিকে মসজিদে পরিণত করা যায় তা খতিয়ে দেখতে।

পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স চার্চের প্রধান–যাকে বলা হয় ইকিউমেনিক্যাল প্যাট্রিয়ার্ক অব কনস্টান্টিনোপল–তার দফতর এখনো ইস্তাম্বুলে। গত মঙ্গলবার প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম বার্থোলোমিউ সতর্ক করে দেন যে, এ ভবনকে মসজিদে পরিণত করা হলে সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ খ্রীষ্টান মর্মাহত হবে এবং দুই দুনিয়ার মধ্যে ফাটল দেখা দেবে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, হাগিয়া সোফিয়ায় কোন পরিবর্তন আনা হলে তা এখন যেভাবে দুই ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সেতু হিসেবে কাজ করছে তা বিনষ্ট হবে।

গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন এ্যাম্বাসাডর এ্যাট লার্জ স্যাম ব্রাউনব্যাক তুরস্কের প্রতি আহবান জানিয়েছেন যেন হাগিয়া সোফিয়া এখন যে অবস্থায় আছে তেমনি রাখা হয়।

কিন্তু তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু জোর দিয়ে বলেছেন, এ ভবনটির অবস্থান তুরস্কের ভূখন্ডে, তাই এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গ্রীসের কিছু বলার থাকতে পারে না।

‍“আমরা আমাদের দেশে আমাদের সম্পদ নিয়ে কী করছি তা আমাদের বিষয়” – তুরস্কের টুয়েন্টিফোর টিভিকে বলেন মি. কাভুসোগলু।

তথ্য সহায়তা: বিবিসি

No comments:

Post a Comment

ছয় যমজ সন্তান নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন জার্মান নারী

  ছয় যমজ সন্তান নিয়ে এক দশক আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন জার্মানির রুকসানা তামিজ। মুসলিম হবার পর হিজাব পরা শুরু করেন এবং পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন অনুশ...