দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের লক্ষ্য করে ব্রিটেন বিভিন্ন ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস স্যাংশন্স রেজিম নামের এক নতুন আইনে গুরুতর লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। গত সোমবার রাশিয়া, সৌদি আরব, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার ৪৭ জন ব্যক্তি এবং দুটি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্রিটেনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও দেশটিতে থাকা তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণার মাধ্যমে এ নতুন আইন কার্যকর হয়েছে।
এ আইনের কথা ঘোষণার সময়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব বলেন, ব্রিটিশ জনগণের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা হচ্ছে, ‘যাদের হাতে রক্ত আছে, স্বৈরাচারের পান্ডা, স্বৈরশাসকের গুন্ডারা এ দেশে অবাধে বিচরণ করতে পারবে না, কিংস রোডে ঘরবাড়ি কিনতে পারবে না, নাইটসব্রিজে বড়দিনের বাজার করতে পারবে না। তাদের কালোটাকা ব্রিটিশ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর মাধ্যমে লেনদেন করতে পারবে না।’
আইনটি অবশ্য ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্ট নামেও পরিচিত। ২০০৯ সালে মস্কোর কারাগারে হেফাজতে নিহত একজন রুশ আইনজীবী সের্গেই ম্যাগনেটস্কির নাম অনুসারে এ মানবাধিকার রক্ষার আইনটি পরিচিতি লাভ করে। রুশ কর কর্মকর্তাদের ব্রিটেনে ২৩ কোটি ডলারের জালিয়াতির তথ্য প্রকাশের কারণে সের্গেই ম্যাগনেটস্কিকে রুশ নিরাপত্তা বাহিনী আটক করেছিল। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রথম ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্ট তৈরি করে। পরে কানাডা এবং বাল্টিক অঞ্চলের কয়েকটি রাষ্ট্রও এ একই ধরণের আইন করেছে। ব্রিটেনে ২০১২ সালেই এ আইন তৈরির দাবি ওঠেছিল এবং ২০১৮ সালে তার খসড়া পার্লামেন্টের কমিটি পর্যায়ে অনুমোদিত হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও একই ধরণের আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও এ ধরণের আইন করছে বলে সোমবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব পার্লামেন্টে জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাব হাউস অব কমন্সে অনুষ্ঠিত বিতর্কে বলেন যে এ আইনের নিষেধাজ্ঞা এমন এক হাতিয়ার, যা কোনো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে অপরাধীকে লক্ষ্যে করে প্রয়োগ করা যাবে। মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য এ আইনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে। মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে যেগুলো বিবেচিত হবে, সেগুলো হচ্ছে প্রথমত, জীবন ধারণের অধিকার যেখানে হত্যা বা বিচারবহির্ভূত হত্যায় হুমকির মুখে পড়ে; দ্বিতীয়ত, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা, অমানবিক এবং অবমাননাকর আচরণ ও সাজার শিকার না হবার অধিকার এবং তৃতীয়ত, দাসত্ব অথবা জবরদস্তি মূলক শ্রমে বাধ্য না করার অধিকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাব জানান, এ আইনে এসব অপরাধে সহায়তা, উসকানি ও তার প্রসারে যারা জড়িত, তাদের বৃহত্তর নেটওয়ার্কের সবাইকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা সম্ভব হবে। এটি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার বাইরেও রাষ্ট্রীয় কেউ নন, এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র পরে এলবিসি রেডিওকে বলেছেন যে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে অথবা ধর্মবিশ্বাসের কারণে কাউকে বেআইনিভাবে হত্যা করার মতো ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদেরও এ আইনের আওতায় আনা হবে।
এ আইনে যাঁদের ওপর প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন ম্যাগনেটস্কির মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত এবং দায়ী হিসেবে অভিযোগ রয়েছে, এমন ২৫ জন রুশ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে আছেন রুশ তদন্ত সংস্থার প্রধান আলেক্সান্ডার বাস্ত্রিকিন। যাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রও ২০১৭ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ ছাড়া ম্যাগনেটস্কি যে কারাগারে আটক ছিলেন, সে কারাগারের চিকিৎসক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে-এমন ২০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল অং হ্লাইং এবং তাঁর ডেপুটি জেনারেল সো উইন। রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিপীড়ন-নির্যাতনের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উত্তর কোরিয়ার দুটি সংগঠন, যাদের বিরুদ্ধে জবরদস্তি মূলক শ্রমে বাধ্য করার অভিযোগ আছে।
ব্রিটেনে এ আইনের প্রতি সর্বদলীয় সমর্থন থাকলেও এর প্রয়োগ কতটা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হবে, তা নিয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী-উভয় পক্ষের এমপিদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের নিপীড়নের অভিযোগ সত্ত্বেও চায়নার কারও বিরুদ্ধে কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দেশটির প্রধান নির্বাহী ক্যারি ল্যামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির সাবেক নেতা স্যার আয়ান ডানকান স্মিথ।
ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্টকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অন্যতম একটি যথার্থ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে দুনিয়াজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন যে ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে, তার আলোকে মানবাধিকার কর্মীরা এর কার্যকারিতাকে সীমিত বলেই মনে করেন। বিশেষ করে এ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দেয়। এ আইন সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আইনটি প্রয়োগে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিমালা স্পষ্ট নয়। ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কিউবা, নিকারাগুয়াসহ অনেক দেশের রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ আইনে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও অন্য অনেক দেশে একই রকম অপরাধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় থেকেছে। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও একই ধরণের প্রশ্ন ওঠতে বাধ্য। হাউস অব কমন্সে সোমবারের বিতর্কে এমপিদের অনেকের বক্তব্যেই সে সংশয়-সন্দেহের কথা ওঠে এসেছে।
মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই বিভিন্ন দেশের নেতাদের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার প্রবণতার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে নেতারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিবেশ সৃষ্টি করেন, সেখানে শুধু তাঁদের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা প্রত্যাশিত ফল দেবে না। তবে এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নতুন এ ব্রিটিশ আইন এবং বেছে বেছে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো ব্যবস্থা গ্রহণকে দুনিয়ার সব দেশের রাজনীতিক, সরকারি এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের প্রতি একটি শক্তিশালী হুঁশিয়ারি বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বার্তাটি হচ্ছে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কেউ দেশের সীমানার মধ্যে দায়মুক্তি ভোগ করলেও বিদেশে তাঁকে তার পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। ব্রিটেনের সাথে কমনওয়েলথ দেশগুলোর নানা দিক থেকে বন্ধন ঘনিষ্ঠ হবার কারণে ওই সব দেশের জন্য এ আইনের কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব থাকাই স্বাভাবিক।
তথ্য সূত্র: ওয়েব
No comments:
Post a Comment